অণু পরিমাণ ঈমান?

                                 অণু পরিমাণ ঈমান


কিছুদিন আগের কথা। স্কুল থেকে ফেরার পরপরই প্রশ্ন নিয়ে হাজির হল আমার ছেলে। স্কুলে টিচারের কাছ থেকে একটি হাদিস শুনেছে। প্রশ্ন সেই হাদিস নিয়ে। হাদিসটি বিখ্যাত। আপনারা সবাই শুনে থাকবেন। হাদিসটি হলো,


রাসূলুল্লাহ বলেছেন,


خرج من النار من كان في قلبه مثقال درة من الإيمان


যায় অন্তরে সামান্যতম ঈমান আছে, সে (কোন এক সময়) জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে।    

আমার ছেলে প্রশ্ন করল, 'আব্বু। এখানে কি ওইসব মানুষদের কথা বলা হচ্ছে, আল্লাহকে নিয়ে যাদের সন্দেহ আছে? আল্লাহ আছেন কি না সেটা নিয়ে যারা নিশ্চিত না, আবার কিছুটা বিশ্বাস আছে, ওরাও কি জান্নাতে যাবে?

‘না, অবশ্যই না।‌'

তাহলে হাদিসে কাদের কথা বলা হচ্ছে?

ওর প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য চটজলদি করে কয়েকজনের আলিমের কাছ থেকে বিষয়টি জেনে নেয়ার চেষ্টা করলাম।

অন্তরে সরিষাদানা পরিমাণে ঈমান থাকলেও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁকে জাহান্নামের আগুন থেকে বের করে আনবেন, এই হাদিসটি দ্বারা কী বােঝানাে হয়েছে?

এ ব্যাপারে যে হাদিসগুলো আছে তার সবগুলাে সহিহ।

আমার প্রশ্নের জবাবে একজন বললেন, 'এর অর্থ হলাে, তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে, কিন্তু তাদের অন্তরে কিছু সন্দেহ আছে। তারা আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী। তবে সেই বিশ্বাসে কিছু সংশয় মেশানাে আছে।

এটা তাে ঈমান হলাে না। সংজ্ঞানুযায়ী ঈমান অর্থ দৃঢ় বিশ্বাস। দৃঢ় বিশ্বাস না থাকলে সেটা ঈমান হতে পারে না', আমি বললাম।

তিনি আর কিছু না বলে চুপ হয়ে গেলেন।

আরেকজন বললেন," এর অর্থ হলাে তারা আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে, কিন্তু আর কিছু করে না। তারা কোনাে হুকুম-আহকাম মেনে চলে না। তাদের শুধু বিশ্বাসটাই আছে।"

আমি বললাম, তাহলে তাে ইবলিস আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী। কিন্তু সে আল্লাহর আনুগত্য করে না। ওর কী হবে?

তিনিও চুপ হয়ে গেলেন।

এ কথােপকথনগুলাের পর আমার মনে হলো শুধু শিশুরা না, বড়দের মাঝেও এ হাদিসের অর্থ নিয়ে কনফিউশান আছে। এ হাদিসের অর্থ আমাদের অনেকের কাছেই আসলে স্পষ্ট না।

আসুন আমরা হাদিসটির সঠিক অর্থ জানার ও বােঝার চেষ্টা করি। সহীহ হাদিসে এসেছে, কারো অন্তরে অণু পরিমাণ বা সরিষাদানা পবিমাণে ঈমান থাকলে আল্লাহ তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে বের করে আনবেন।

হাদিসটি আসলে অন্তরের আমলে সাথে সম্পর্কিত। এখানে অন্তরের আমলের দিকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে। অন্তরের আমলের কী?

অন্তরের আমল হলাে আল্লাহর জন্য ভালােবাসা, আল্লাহর ওপর ভরসা করা, তকে মহিমান্বিত করা, তাঁর প্রশংসা করা, তাঁকে ভয় করা, আল্লাহর রাহমাহ ও ক্ষমাশীলতার ব্যাপার আশা রাখা।

অন্তরের আমলগুলাের বিভিন্ন পর্যায় বা লেভেল আছে। যেমন ধরুন, আল্লাহকে ভালােবাসা। এই ভালােবাসার কিন্তু অনেক পর্যায় হতে পারে। যেমন একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের ভালােবাসা। একেবারে সর্বনিম্ন পরিমাণ। যার অন্তরে এটুকু আছে, সে আল্লাহকে ভালােবাসে, কিন্তু সেই ভালােবাসা বেশ দুর্বল।

লক্ষ করুন!

এই ভালােবাসার ভ্যালু কিন্তু নেগেটিভ না। অর্থাৎ সে আল্লাহকে ঘৃণা করে না। এই ভালােবাসার ভালু নিউট্রালও না। অর্থাৎ ভালােওবাসে না আবার ঘৃণাও করে না, ব্যাপারটা এমন না। তার ভালােবাসা পযিটিভ। অন্তরে রাব্বুল আলামীনের প্রতি ভালােবাসা আছে, যদিও সেটা খুব দুর্বল।

এই ভালােবাসা দুর্বল হলেও, এটা তাকে কুফর থেকে বাঁচিয়ে রাখে। এবং এ ভালােবাসার কারণে একসময় সে জান্নাতে যাবে। তবে এ 'ভালােবাসা তাঁকে গুনাহ বা আখিরাতে শান্তি থেকে বাঁচাতে পারবে না। গুনাহ থেকে বাঁচতে হলে আবশ্যিক পরিমাণ ভালােবাসা লাগবে।


আবশ্যিক ভালােবাসা কী?


আল্লাহ সূরা তাওবাহয় বলেন,


ثان إن كان أباكم وأنتائم واخوانكم وأزواگن وغیٹگم وأقوال اتروفا وقارة وی گشادها وماكن تصوتها أخي إليكم من الله ورسوله وجهاد في شيله والله لا يهدي القوم الفاسقين فتوا خلي ياني الله بأمره


বলো, (হে মুহাম্মদ),


যাদি তােমাদের পিতারা, আর তােমাদের সম্ভানেরা, আর তােমাদের ভাইয়েরা, আর তােমাদের স্ত্রীরা, আর তােমাদের গোষ্ঠীর লােকেরা আর ধন-সম্পদ, যা তােমরা অর্জন করেছ, আর ব্যবসা, তোমরা যার মন্দার ভয় করাে, আর বাসস্থান, যা তােমরা ভালােবাসাে (এসব) যদি তোমাদের কাছে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পথে জিহাদ করার চেয়েও অধিক প্রিয় হয় তবে তােমরা অপেক্ষা করাে আল্লাহ তার নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হিদায়াত দান করেন না।

                                                  [তরজমা, সূরা তাওবাহ, ২৪]

অর্থাৎ আল্লাহ এখানে আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন, ফাসিক হওয়া থেকে বাঁচতে হলে, গুনাহ ও শাস্তি থেকে বাঁচতে হলে আল্লাহর প্রতি এই পরিমাণ ভালােবাসা থাকতে হবে। আবশ্যিক ভালোবাসার পর্যায়ে পৌছাতে হলে এ আয়াতে আল্লাহ যে। বিষয়গুলাের কথা উল্লেখ করেছেন সেগুলাের চেয়ে আল্লাহর আদেশ পালনকে বেশি ভালােবাসতে হবে। আর এই আবশ্যিক ভালােবাসার পরে আছে পরিপূর্ণ ভালােবাসা বা পরম ভালােবাসা। নবীগণ , সিদ্দিকগণ এবং ঈমানের পথে যারা অগ্রগামী তারা অন্তরে আল্লাহর প্রতি এই পরিপূর্ণ ভালােবাসা ধারণ করেন।

আল্লাহভীতি বা আল্লাহকে মহিমাখিত করার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই রকম। এমন কিছু মানুষ থাকে, যাদের মনে আল্লাহর ভয় আছে। যারা আল্লাহর প্রশংসা করে, তাকে মহিমাথিত করে। কিন্তু এগুলাের পরিমাণ খুবই কম। যতটুকু না থাকলেই না। লক্ষ করুন! তারা আল্লাহকে ভয় করে। তাদের অন্তরে আল্লাহর প্রতি ঘূণা বা অবজ্ঞা


নেই। তারা আল্লাহকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য কিংবা বিল করে না। তারা আল্লাহকে


অস্বীকার করে না, তাকে চ্যালেঞ্জ করে না। তারা আল্লাহর ব্যাপারে উদাসীনও না। ব্যাপারটা এমন না যে, তারা আল্লাহকে ভয়ও করে না আবার ঘৃণা বা চ্যালেও করে না।


তাদের আল্লাহর প্রতি ভয় আছে। তবে তার পরিমাণ খুবই কম। অন্তরের এই অল্প আমল তাদের কুফর থেকে বাঁচাতে পারলেও গুনাহ থেকে রক্ষা করতে পারে না। আল্লাহর বিধানগুলাে তাঁরা পরিপূর্ণভাবে মেনে চলে না।


সুনাহ থেকে বাঁচতে হলে তাদের আবশ্যক পরিমাণ আল্লাহভীতি থাকতে হবে, যা তাদের চালিত করবে ফরজ কাজগুলাে আন্তরিকভাবে করতে, বড় বড় গুনাহলে থেকে বেঁচে থাকতে এবং ছোট-বড় যেকোনাে শুনাহের জন্যে তাওবাহ করতে।


ঈমানের আরও ওপরের পর্যায়ে যেতে হলে আল্লাহর ব্যাপারে পরিপূর্ণ ভয় অর্জন করতে হবে। একই কথা প্রযােজ্য অন্তরের অন্য আমলগুলাের ক্ষেত্রে


কাজেই হাদিসে ‘অণু পরিমাণ ঈমান' বা 'সরিষাদানার পরিমাণ ঈমান' বলতে শুধু আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসকে বােঝানাে হচ্ছে না; বরং অন্তরের আমলগুলাের কথাও বলা হচ্ছে।


অবশ্যই ঈমান আর ইয়াকিন এর মধ্যে পার্থক্য আছে। কিন্তু যে বিশ্বাসের মধ্যে সন্দেহ মিশে আছে ইসলামের অবস্থান থেকে সেটা কোনাে বিশ্বাসই না। সন্দেহ-মিশ্রিত বিশ্বাসকে ঈমান বলা যায় না। লক্ষ করুন, এখানে আমরা ঈমানের সংজ্ঞার কথা বলছি না। ঈমানের সংজ্ঞার মধ্যে আমলের অন্তর্ভুক্তি নিয়েও কথা হচ্ছে না। সেটা আলাদা একটা আলােচনা এবং এ নিয়ে অনেক দলীল আছে। ঈমান থেকে কোনােভাবেই আমলকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। তবে আমাদের এ আলােচনার বিষয় ছিল অন্তবের আমল। এবং আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত। আল্লাহর আপনাদের ওপর শান্তি ও কল্যাণ বর্ষণ করুন।

Post a Comment

0 Comments