প্রিয় সারার জন্য...
আমার মেয়ের ক্যান্সার ছিল। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ -এর সিদ্ধান্ত নিয়ে ও কখনাে অসন্তুষ্ট ছিল না। কালকে আমাকে বলছিল—“বাবা, আমাকে কুরআনের কিছু আয়াত তিলাওয়াত করে শােনাও। জান্নাতের বর্ণনা এর পুরস্কারের আয়াতগুলাে পড়ো।
আলহামদুলিল্লাহ।
ক্যান্সার ওর ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়েছিল। মাঝেমাঝে খুব শ্বাসকষ্ট হতাে। কযেক দিন আগে খুব বেশি কষ্ট হচ্ছিল। নিশ্বাস নিতে পারছিল না। এমন অবস্থাতেও আমার মেয়ে বলছিল,
"লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ইয়া আল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ"
আল্লাহর কসম! আমি এর ব্যাপারে মহান আল্লাহর কাছ থেকে ভালাে ছাড়া আর কিছু আশা করি না। আল্লাহ ওকে সম্মানিত করবেন ইন শা আল্লাহ। বিশেষ করে ওর বয়স যেহেতু খুব অল্প ছিল। ও ছিল একটা শিশু, যার হিসেবের খাতা এখনাে খােলেনি। আল্লাহর কসম! আমার দৃঢ় বিশ্বাস আল্লাহ ঐ ওকে সম্মানিত করবেন। আমার আর আমার পরিবারের জন্য কাজটা এখন খুব সহজ। আমাদের এখন শুধু নেক আমল করে যেতে হবে, যাতে আল্লাহর ইচ্ছায় জান্নাতে আমরা ওর সাথে একত্র হতে পারি।
(দু বছর ক্যান্সার সাথে লড়াই করার পর ২০১৯ এর ৭ই জুন মারা যায় ড, ইয়াদ কুনাইবীর মেয়ে সারা। এ লেখাটি সারার দাফনের আগে ড, ইয়াদ কুনাইবীর বক্তব্যের লিখিত রূপ।)
আল্লাহ বলেন,
যারা ঈমান আনে আর তাদের সন্তানসন্ততিরা ঈমানের সাথে পিতামাতাকে অনুসরণ করে, আমি তাদের সাথে তাদের সন্তানসন্ততিকে মিলিত করব। তাদের আমালের কোনাে কিছু থেকেই আমি তাদের বঞ্চিত করব না। প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজ কৃতকর্মের জন্য দায়বদ্ধ। [তরজমা, সূরা আত-তূর, ২১]
কিন্তু আমি এই পিতার দুঃখ কল্পনাও করতে পারি না, যে শৈশবে তার সন্তানকে অবহেলা করে। আর একসময় আবিষ্কার করে সন্তান ভয়ংকর শুনাহতে জড়িয়ে গেছে, কিংবা ইসলাম থেকে বেরিয়ে গেছে। আমি ভেবে পাই না কীভাবে এমন অবস্থায় একজন পিতা খাওয়া, ঘুম চালিয়ে যেতে পারে।
তার অন্তর অনুশােচনায় ভরে থাকার কথা। আজকের এই অবহেলার কারণে একসময় পুরো পরিবারও হয়তাে দ্বীন ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারে। আবার এমন হতে পারে যে পিতা জান্নাতে কিন্তু সন্তান জাহান্নামে। এ হলো এমন বিচ্ছেদ, যার পর আর মিলন হবে না। মুসলিম বাবা জান্নাতে যাবে আর তার সন্ধান ইসলাম ত্যাগ করার কারণে জাহান্নামে যাবে। আল্লাহর কসম! এর চেয়ে তীব্র অনুশোচনার আর কিছু হতে পারে না।
আল্লাহ বলেন,
বলাে, যারা নিজেদের আর নিজেদের পরিবার-পরিজনকে কিয়ামতের দিনে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তারাই তাে ক্ষতিগ্রস্ত। জেনে রেখো, এটাই হলাে স্পষ্ট ক্ষতি।[তরজমা, সূরা আয-যুমার, ১৫]
আমার মেয়েটা আমাকে ছেড়ে আল্লাহর কাছে চলে গেছে। আমার বুকটা ভেঙে যাচ্ছে। কিন্তু এ কষ্টের সাথে স্বস্তিও আছে। আমি আল্লাহর সিদ্ধান্তে খুশি, আমি আমার রবের সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট। আমি খুশি যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমার মেয়েটাকে এমন অবস্থায় দুনিয়া থেকে নিয়ে গেছেন।
আমার ভাইরা, আমি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি-----যদি আপনি কাউকে ভালােবাসেন, আপনার মা, বাবা, স্ত্রী, সন্তান, ভাই-বােনদের ইসলামের ব্যাপারে নাসীহাহ করুন। তাদের ইসলামের দিকে ডাকুন। তাদের সময় দিন। তাদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হােন। মৃত্যুর আগে যেন তাঁরা তাওবাহ করতে পারে সেই চেষ্টা করুন। আপনার সর্বশক্তি এই দিকে দিন।
আজকের এ অবহেলার কারণে আপনার প্রিয় কোনাে মানুষ যদি কুফরের ওপর কিংবা বড় কোনাে গুনাহের ওপর মারা যায় তাহলে আপনি সারা জীবন আফসােস করবেন। নিজে হিদায়াত পেলেও এই তিক্ততা বয়ে বেড়াতে হবে পুরাে জীবন জুড়ে।
আপনাদের প্রতি এই হলাে আমার নাসীহাহ। রাসূলুল্লাহ -এর কথা চিন্তা করুন। তাঁর প্রিয় চাচা আবু তালিব যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন আকুল হয়ে রাসূলুল্লাহ বারবার বলেছিলেন,
চাচাজান! আপনি শুধু লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলুন। এটুকু বলুন তাহলে আল্লাহর কাছে আমি আপনার জন্য সুপারিশ করতে পারব। শুধু এইটুকু বলুন, আমি আশা রাখি আল্লাহ আপনার ওপর রহম করাবেন।
বলুন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।
আবু তালিব তার সারাজীবন রাসূলুল্লাহ -কে সাহায্য করে গেছেন। তিনি ছিলেন মক্কার কুরাইশদের হামলার সামনে এক দুর্গের মতাে। রাসূলুল্লাহ -এর জন্য তিনি নিজেকে, নিজের সম্পদ ও সন্তানকে কুরবান করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই রাসূলুল্লাহ উদগ্রীব হয়ে চাচ্ছিলেন প্রিয় চাচাজান তাঁর সাথে জান্নাতে থাকুন।
কিন্তু আবু তালিব মারা গেলেন আব্দুল মুত্তালিবেব মিল্লাতের ওপর। তার পূর্বপুরুষদের ধর্মের ওপর। শিরকের ওপর।
চিন্তা করুন এটা রাসূলুল্লাহ -এর জন্য কত কষ্টকর ছিল। যতবার আমি বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করি, সহ্য করতে পারি না। আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, সুম্মা আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ ও আমাকে এমন এক কন্যা দিয়ে সম্মানিত করেছেন, যে সাবরের সাথে, আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি পূর্ণ সন্তুষ্টি নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে।
যখন একদম দুর্বল হয়ে পড়েছিল, দাঁড়াতে পারত না। মাথা ঘুরে পড়ে যেত। তখনো ঘুম থেকে উঠে বলত, "আমি যুহরের সালাত পড়িনি। আমি যুহরের সালাত পড়ব।
ও হিজাব পালন করত। নিজের আচার-আচরণ, চলাফেরায় শরীয়াহর বিধান মেনে চলার চেষ্টা করত। ইসলাম নিয়ে কাউকে কটু মন্তব্য করতে দেখলে আল্লাহ -এব জন্যে ও ক্রোধান্বিত হতাে। আমাকে বলত, বাবা দেখাে এরা দ্বীনদার মানুষদের নিয়ে কী-সব বলছে! এরা ইসলাম নিয়ে কী বলছে।'
আলহামদুলিল্লাহ আমি আমার রবের ব্যাপারে সুধারণা রাখি। আমি আশা রাখি তিনি আমার মেয়েটাকে সম্মানিত করবেন।
আমার বিশ্বাস—এ দুনিয়াতে আমাদের পাশে থাকার চেয়ে আল্লাহর কাছে থাকা ও জন্য উত্তম। আমার কাজ এখন সােজা। যেটুকু সময় আমার বাকি আছে সেটা নেক আমলে খরচ করা। যাতে আল্লাহর ইচ্ছায় আখিরাতে আমি আমার মেয়েটার সাথে থাকতে পারি। আলহামদুলিল্লাহি রাব্বীল আলামীন। আপনারা কষ্ট করে এসেছেন, আল্লাহ আপনাদের সবাইকে উত্তম প্রতিদান দিন। আমি আল্লাহর কাছে দু'আ করি, তিনি যেন আপনার প্রিয়জনদের হিদায়েত করার দ্বারা আপনাদের সম্মানিত করেন। এবং কোনাে শাস্তি ছাড়াই আপনাদের জান্নাতে একত্রিত করেন।
0 Comments